শফিউর রহমান – নিরাপত্তার আশায় এসে এই শরণার্থীরা বাংলাদেশি সরকারের কাছে আরও নিগ্রহের শিকার হয়েছে, কারণ তারা এদের সরকারের মতোই এদের বিতারিত করতে চেয়েছে।
কুতুপালং দিয়ে হেঁটে গেলে যেসব প্রতিষ্ঠান, আচার-আচরণ এবং সম্পর্ক এই জায়গাটি তৈরি করেছে সেগুলোকে ভেঙে ফেলার একটা প্রচণ্ড ইচ্ছা হবে আপনার। এমনটা করতে চাওয়ার কারণ হচ্ছে আপনার চতুর্দিকে যে ধরণের অসামঞ্জস্য আর অনাচার দেখবেন তার জন্য সহনশীলতার কারণ আপনার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। আপনি যদি বাংলাদেশি হোন আর এই জায়গাটিকে আপনার দেশের অংশ মনে হয়, আপনি কিছুতেই বুঝতে পারবেন না কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে অন্যান্য শক্তিশালী পক্ষকে কি ধরণের উৎসাহ দেয়া আর সাহায্য করা হয়েছে বা হচ্ছে যে কারণে তারা এই জায়গাটি বানিয়ে সেটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কুতুপালংককে আপনার যদি মঞ্চ মনে হয়েও থাকে, যেখানে সমসাময়িক ইতিহাসের নাটক প্রদর্শিত হচ্ছে, আপনি এই রকম পৌনঃপুনিক এবং ব্যয়বহুল উপস্থাপনার অর্থ খুঁজে পাবেন না। দাম দেওয়ার চিত্র চিত্র সর্বত্র বিরাজমান, যেগুলোর কোন যৌক্তিক কারণ আপনি বুঝতে পারবেন না। মিয়ানমারের মানবতা আর শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ আন্তর্জাতিক পরিসরে এখনও ভালভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। কিন্তু মিয়ানমার যে অন্যায় শুরু করেছে তা যে কুতুপালং এর মতো জায়গায়, যেখানে আক্রান্ত মানুষের আশ্রয় মেলার কথা, সেখানে আরও জোরদার হচ্ছে, তা কে বুঝিয়ে বলবে আর কেই বা আমলে নেবে?
অনাকাঙ্খিত বা অনভিপ্রেত ঘটনাকে বিস্মৃত হবার, উপেক্ষা করার আর এড়িয়ে যাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা আছে এই জায়গাটার। সত্যি বলতে, ঘটনাগুলো মনুষ্যত্বের মৌলিক নিয়ম এবং আন্তর্জাতিক আইন, দুইয়েরই বিরোধিতা করে। ৭০ এর দশকের শেষ থেকে শুরু করা যেতে পারে যখন প্রথমবারের মতো একসাথে ২ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়েছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের রিপোর্টে লিখেছে:
নিরাপত্তার আশায় এসে এই শরণার্থীরা বাংলাদেশি সরকারের কাছে আরও নিগ্রহের শিকার হয়েছে, কারণ তারা এদের সরকারের মতোই এদের বিতারিত করতে চেয়েছে। ১২ হাজারের এর উপর শরনার্থী ক্ষুধায় মারা গেছে; কারণ বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্পগুলোতে খাবারের রেশন কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যেন রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে বাধ্য হয়। দুই সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বেশির ভাগ শরণার্থী তাদের আগমনের ১৬ মাসের মাথায় নিজ দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে।
বার্মা থেকে আরেকটা বড় দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সনে। ১৯৯২ আর ১৯৯৩ এর মধ্যে তাদেরকে আবার জোর করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এবারের ঘটনাও ছিল নির্মম। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ আর শরণার্থীদের মাঝে সংঘর্ষে প্রাণহানীও ঘটে। প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হওয়া ৫০ হাজারের মতো শরনার্থীদের তিন বছর পর ইউএনএইচসিআর আর খুঁজে পায়নি। দশ বছরের একটু বেশি সময় পর, ২০০৪ এর নভেম্বর মাসে, বাংলাদেশ ক্যাম্প থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করার আরেকটি ঘটনায় ১২ জনের বেশি রোহিঙ্গার মৃত্যু হয় এবং তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক আহত হয়।
দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের নিজ জনতা ও বহির্বিশ্বের কাছে প্রথম আত্মপক্ষ সমর্থন করা বক্তব্য আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং মান, তদুপরি নিজেদের নাগরিকদের শরনার্থী হওয়ার ইতিহাস উপেক্ষা করে; কারণ বাংলাদেশ নিজেকে দারিদ্র্যের জন্য বিশাল সংখ্যায় আগত শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে অনুপযুক্ত ঘোষণা করে। ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, তাদের বক্তব্যের পরিসর, চিন্তার প্রতিফলন এবং নীতি প্রণয়ন একই রকম থেকে গেছে গত চার দশকে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। বিগত বছরগুলোতে সরকার ইউএনএইচসিআরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী না ভেবে তাদেরকে ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত, যেটা সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে। এ কারণে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা ও অসহায়ত্ব কোন উদ্বেগের কারণ ঘটায়নি। এদেরকে ফেরত পাঠানোটাই মুখ্য।
শরণার্থীদের ইতিহাসে এই ধরণের কার্যাবলী অপর্যাপ্ত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরেও এইসব বিচ্যুতি সম্পর্কে কোন সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়নি কেন? একটা কারণ হলো, স্থানীয়ভাবে একীভূত হওয়া অথবা বসবাসের নিষ্পত্তি ঘটা প্রত্যাবর্তনের অন্তরায়। এটা বোঝা সহজ। কিন্তু যেটা বোধগম্য নয় তা হলো ২০১৮ তে এসেও কীভাবে প্রত্যাবাসনকে সম্ভবপর লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যেখানে সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করছে যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের চক্রাকারে হাজিরা বৃদ্ধির মূল কারণই হচ্ছে মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা এবং তাদেরকে ধ্বংসাত্মক হয়রানীর মধ্যে ফেলা? এই যন্ত্রণাগুলো আমরা মোটামুটিভাবে একত্রিত করতে পারি: খুন, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, জোরকৃত স্থানান্তর, ক্যাম্পে জড়ো করা, জমি ও সম্পত্তি অধিগ্রহণ, কায়িক শ্রমে বাধ্য করা, শিক্ষায় ও চাকুরীতে এবং জনসেবায় অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত করা, বিবাহে বিধিনিষেধ আরোপ করা, ধর্মপালনের অধিকার খর্ব করা এবং মসজিদগুলো ধ্বংস করা ইত্যাদি।
এর ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গা শিশুরা দারিদ্রের মধ্যে বড় হচ্ছে; তাদের কোনো সুযোগ সুবিধা থাকছে না এবং তাদের সামাজিক অগ্রগতির কোনো সম্ভাবনাই তৈরি হচ্ছে না। তারা এমন একটা পরিবেশে বেড়ে উঠছে যার স্বরূপ এখানে তুলে ধরা অসম্ভব। পরিস্থিতির অসহায়ত্ব বুঝতে হলে আপনাকে জায়গাটা দেখে আসতে হবে। তবে, যখন আপনি বাচ্চাদেরকে খেলতে দেখবেন ও শুনবেন, তখন আপনার মনে হবে তাদের কণ্ঠস্বরের পর্দা, ওঠানামা এবং অভিব্যক্তি এই গ্রহের অন্য জায়গার বাচ্চাদের চাইতে কিছুমাত্র আলাদা নয়। তাদের চিৎকার আপনাকে বলে দেবে যে তারা বেঁচে আছে, রোগ ও অপুষ্টি ছাপিয়ে তারা আশা নিয়ে আছে।
ফয়েড শোকগ্রস্ততা ও বিষণ্নতার মধ্যে পার্থক্য করেন। আমি যেটুকু পড়েছি তাতে, শোকগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষতি স্বীকার করে এগিয়ে যান। বিষণ্নতার ক্ষেত্রে ব্যক্তি ক্ষতি স্বীকার করতে পারেন না। ক্ষতির প্রভাব তার অস্তিত্বকে নাড়া দেয় এবং তিনি তা ক্ষণে ক্ষণে মনে করতে থাকেন। কুতুপালং দিয়ে হাঁটতে থাকলে, বিষণ্নতা এসে ভর করে, কারণ বাংলাদেশ সরকার অন্য কোনো কিছুর অবকাশ রাখতে দেবে না।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-